ভূমিকা
ক্যারিয়ারর গাইডেন্স' হচ্ছে এমন বিশেষ ধরণের সহায়ক কার্যক্রম যার মাধ্যমে একজন শিক্ষার্থী বা ব্যক্তি তাঁর স্বীয় মেধা (Talent), ঝোঁক (Aptitude), সামর্থ ( Strength), যোগ্যতা ( Qualification) ও পেশাগত দক্ষতার (Professional Expertise) সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে শিখবে এবং সামাজিক প্রতিষ্ঠা ও স্বীকৃতি অর্জন করতে সক্ষম হবে। প্রতিটি ব্যক্তিমাত্রই নিজস্ব মেধা, ঝোঁক, বৈশিষ্ট্য ও যোগ্যতার অধিকারী। স্বীয় প্রতিভাকে জানতে পারা এবং নিজস্ব সামর্থের সর্বোত্তম ব্যবহার করতে পারা প্রতিটি ব্যক্তির জীবনে সাফল্য লাভের জন্য একান্ত প্রয়োজন। ক্যারিয়ার গাইডেন্স একটি কার্যকর ও সহায়ক মাধ্যম হিসেবে বিশ্বব্যাপী গন্য হয়ে আসছে। আধুনিক বিশ্বে ক্যারিয়ার গাইডেন্স কার্যক্রমকে বিশ্বব্যাপী শিক্ষার্থীদের জীবনগঠন এবং সাফল্য অর্জনের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ন বিষয় হিসেবে গন্য করা হচ্ছে। সেই প্রেক্ষাপটে ভোকেশনাল শিক্ষার্থীদের উন্নত জীবন গঠন এবং সাফল্য লাভের জন ক্যারিয়ার গাইডেন্স একান্ত প্রয়োজন ।
'Vocation' শব্দটি ল্যাটিন শব্দ 'Vocare' বা 'Vocationem' হতে উদ্ভূত যার অর্থ আহবান করা ( To Call) । পঞ্চদশ শতকে সর্বপ্রথম ‘ভোকেশনাল' শব্দটি ধর্মবিশ্বাসে প্রবৃত্ত হওয়া অর্থে ব্যবহৃত হয়। আধুনিক বিশ্বে ‘ভোকেশন' বা ভোকেশনাল' শব্দটি শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, পেশা এবং কর্মজগতে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ‘ভোকেশন” শব্দটির সমার্থক শব্দ হচ্ছে পেশা, জীবিকা, বৃত্তি, প্রবৃত্তি, ব্যবসা প্রভৃতি। বৃত্তি বা পেশা গ্রহণ করা প্রতিটি মানুষের স্বভাবজাত কাজ। মানুষমাত্রই তার স্বীয় যোগ্যতা, শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে পেশা নির্বাচন করতে চায়। অতএব, জীবিকা অর্জনের জন্য যে অবলম্বন গ্রহণ করা হয় তাকে ‘ভোকেশন' বা 'বৃত্তি বা 'পেশা' বলে। অন্য কথায় নিজের জীবিকা ও প্রতিষ্ঠা লাভ করার পেশাকে ভোকেশন বা বৃত্তি বলে ।
বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড কর্তৃক বিভিন্ন পেশাভিত্তিক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ কোর্স চলমান রয়েছে। যার মুল উদ্দেশ্য হচ্ছে এসব পেশাভিত্তিক দক্ষ কর্মী তৈরী করা এবং প্রশিক্ষিত ব্যক্তির জীবনের আর্থিক সমৃদ্ধি ও সামাজিক স্বীকৃতি নিশ্চিত করা । এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য পেশা হচ্ছে, আইটি সাপোর্ট টেকনিশিয়ান, ইলেকট্রিশিয়ান, ওয়েল্ডার, কার্পেন্টার, সুয়িং মেশিন অপারেটর, রেডিও টিভি মেকানিক্স, পাইপ ফিটার, ম্যাশন, ড্রাইভিং কাম অটো মেকানিক্স, জেনারেল মেকানিক্স, মেশিনিস্ট ইত্যাদি।
ভোকেশনাল বা বৃত্তিমূলক শিক্ষার মুল উদ্দেশ্য হলো স্বীয় জ্ঞান ও দক্ষতার যথাযথ প্রয়োগ করে কর্মজগতে প্রতিষ্ঠা লাভ করা। এজন্য প্রয়োজন একজন শিক্ষার্থীকে তাঁর স্বীয় মেধা, ঝোঁক এবং সামর্থ সম্পর্কে সচেতন করা, স্বীয় জ্ঞান ও দক্ষতা কাজে লাগিয়ে কীভাবে কর্মজগতে নিজকে প্রতিষ্ঠিত করবে সে সম্পর্কে সচেতন ও আগ্রহী করে তেলা, কর্মজগতের দক্ষতা ও চাহিদা সম্পর্কে সচেতন করা এবং নিজের ক্যারিয়ার কীভাবে গড়ে তুলবে সে সম্পর্কে দিক নির্দেশনা প্রদান কর । এজন্য ক্যারিয়ার গাইডেন্স তথা ক্যারিয়ার শিক্ষার প্রধান এবং পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত দুটি উপাদান রয়েছে।
১। নিজকে জানা
২। কর্মজগতকে জানা
৩। বিকল্প পেশা ও জীবিকা সম্পর্কে জানা । (Understanding Career Alternative )
৪। ক্যারিয়ার গঠনের পরিকল্পনা জানা
অর্থাৎ ক্যারিয়ার শিক্ষার মাধ্যমে প্রতিটি শিক্ষর্থী প্রথমত নিজের সামর্থ, ঝোঁক প্রবনতা, দূর্বলতা, সূযোগ-সম্ভাবনা সম্পর্কে অবহিত হবে। অর্থাৎ সে নিজকে জানবে, নিজের লুকায়িত প্রতিভাকে উন্মোচনের চেষ্টা করবে, নিজের ভবিষৎ জীবনের সম্ভাবনাকে জানার চেষ্টা করবে। দ্বিতীয়ত একজন শিক্ষার্থী কর্মজগতকে জানবে, অর্থাৎ কর্মজগতের সাথে নিজকে পরিচিত করবে। কর্মজগতের যে সব নতুন নতুন দক্ষতার উদ্ভব হচ্ছে তা জানবে এবং নিজকে কর্মজগতের পরিবর্তনের সাথে হালনাগাদ করতে উদ্বুদ্ধ হবে। তৃতীয়ত কর্মজগতে যেসব নতুন নতুন পেশার উদ্ভব হচ্ছে সে সম্পর্কে অবহিত হবে এবং নিজের সম্ভাব্য পেশা সম্পর্কে আগাম সচেতনতা সৃষ্টি হবে। নিজের সম্ভাব্য ক্যারিয়ার গঠনের একটি স্বপ্ন শিক্ষার্থীদের মধ্যে জাগ্রত হবে। সামগ্রিকভাবে ক্যারিয়ার শিক্ষা নিজের সম্ভাবনা সম্পর্কে জানা থেকে শুরু করে ভবিষৎ ক্যারিয়ার গঠনের কাজকে সম্পন্ন করতে শিক্ষার্থীকে সহায়তা করবে। সেজন্য ক্যারিয়ার শিক্ষাকে স্বপ্নের ক্যারিয়ার গঠনের প্রধান ও কার্যকর অবলম্বন হিসেবে গণ্য করা হয়
তোমার ব্যক্তিগত তথ্য (Personal Information । Strength), ঝাঁক (Aptitude) এবং ভবিষৎ স্বপ্নের ক্যারিয়ার ( Dream Career) সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায় এমন একটি জীবন বৃত্তান্ত তৈরী কর।
ক্যারিয়ারের রূপরেখা বা মডেল : মনোবিজ্ঞানী ডোনাল্ড সুপার সময়ের সাথে সাথে এবং অভিজ্ঞতা অর্জনের পরিপ্রেক্ষিতে মানুষের নিজের সম্পর্কে ধারণার পরিবর্তনের ভিত্তিতে একটি মডেল দাঁড় করিয়েছেন । এটিকে রঙধনু জীবন (Life Rainbow) বলা যায়, কারণ এর ধাপগুলোকে রঙধনুর মতো ধাপে ধাপে সাজানো যায় ।
ধাপ | বৈশিষ্ট্য |
প্রথম ধাপ : বৃদ্ধি | নিজের সম্পর্কে ধারণা তৈরি হয় ; দৃষ্টিভঙ্গি, চাহিদা এবং কাজের একটি সাধারণ জগৎ সম্পর্কে ধারণা হয় । |
দ্বিতীয় ধাপ : অনুসন্ধান | বিভিন্ন কাজ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা । পরিবর্তনশীল পছন্দ ও দক্ষতার গঠন । |
তৃতীয় ধাপ : স্থিতি | কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা অর্জনের মধ্য দিয়ে স্থায়ী অবস্থানে পৌছানো । |
চতুর্থ ধাপ : বজায় রাখা | নিজের অবস্থানের উন্নতির জন্য ক্রমাগত পরিবর্তন ও প্রচেষ্টা, মানিয়ে চলা, খাপ খাওয়ানো । |
পঞ্চম ধাপ : প্রতিফলন | ফলাফল বা কমে আসা, অবসর গ্রহণের প্রস্তুতি । |
যদিও ডোনাল্ড সুপার তার পর্যায় বা ধাপগুলোকে বয়স অনুযায়ী ভাগ করেছেন, তবে এই ধাপগুলো ব্যক্তিবিশেষে ভিন্ন হতে পারে ।
আমরা প্রায়ই বিভিন্ন পেশা, বৃত্তি বা নির্দিষ্ট চাকরিতে প্রবেশের স্বপ্ন দেখি। এরূপ স্বপ্নের পেশা নির্ধারণে প্রয়োজনীয় শিক্ষাগত যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা, প্রশিক্ষণ ইত্যাদি ভালোভাবে জেনে নিই । এক্ষেত্রে আমার কোন কোন দক্ষতা কতটুকু আছে তা নির্ধারণপূর্বক নিম্নের ছকটি পূর্ণ করি ।
এবার চিহ্নিত যে যে বিষয়ে আমার আরও যোগ্যতা বা দক্ষতা অর্জন করতে হবে, সেগুলো কীভাবে করতে পারি তা নিয়ে চিন্তা করি ।
এক্ষেত্রে আরও কিছু বিষয় চিন্তা করে দেখি:
যোগ্যতা ও দক্ষতা
এসো দেখি এমন কিছু যোগ্যতা ও দক্ষতা যা কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের জন্য শর্ত হিসেবে দেখা যায় -
লেখার মধ্য দিয়ে সঠিকভাবে যোগাযোগ স্থাপন | তাড়না, প্রেরণা, সক্রিয়তা |
মৌখিক যোগাযোগ | নমনীয়তা |
দলে কাজের যোগ্যতা | পেশাদারী মনোভাব |
আত্মসচেতনতা | ব্যবসায়িক সচেতনতা |
সংখ্যা জ্ঞান বা গাণিতিক দক্ষতা | হিসাব-নিকাশ |
সমস্যা সমাধান বা অনুসন্ধান বিশ্লেষণ | পরিকল্পনা ও সংগঠিত করা |
নেতৃত্ব | সময়নিষ্ঠা |
এসো দেখি এ যোগ্যতাগুলোর কতটুকু আমার আছে, কোথায় আমার ঘাটতি আছে, আমার সুযোগগুলো কী এবং কোন বিষয়টিতে নজর দেওয়া প্রয়োজন।
SWOT (Strengths, Weakness, Opportunities, Threats) Analysis এর মাধ্যমে জানার চেষ্টা করি ।
আমার শক্তি | আমার দুর্বলতা |
আমি দলের মধ্যে ভালোভাবে যোগাযোগ করতে পারি | উপস্থাপনা আমাকে মানসিকভাবে দুর্বল করে দেয় |
আমি আমার লেখাপড়ায় অত্যন্ত মনোযোগী | আমি খুব সূক্ষ্ম ব্যাপারে মনোযোগী নই |
ভবিষ্যতে আমি যে চাকরি করতে চাই তার বাজার খুব ভালো | আমার পছন্দের চাকরির বাজারে অনেক যোগ্য প্রার্থী রয়েছে |
উপরোক্ত সমস্যাগুলো চিহ্নিতকরণ পূর্বক তা সমাধানের উপায় নির্ধারণ করতে হবে ।
সমাধানের উপায় নির্ধারণ
আমাদের জীবনে সব সময়ই কোনো না কোনো সমস্যা সমাধান করতে হয়। যে যত পরিকল্পিত ও বিজ্ঞানভিত্তিক সমস্যা সমাধানে সক্ষম সে তত সাফল্যের দেখা পায় ।
নিচের ধাপগুলো অনুসরণ করে যে কোনো সমস্যার সমাধান করতে পারলে সাফল্য নিশ্চিত ।
সময় গতিশীল । সময়ের এই গতিময়তার সাথে সাথে পরিবর্তিত হয় সমাজ, পরিবর্তিত হয় আমাদের চারপাশ, কাজের পরিবেশ ও প্রেক্ষাপট । আমাদের দেশের কর্মক্ষেত্রেও এসেছে অনেক পরিবর্তন । আজ থেকে চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর আগেও আমাদের দেশের বেশির ভাগ মানুষের পেশা ছিল কৃষিকাজ কিংবা কৃষিভিত্তিক শিল্পে শ্রম দেওয়া। আজ বাংলাদেশ অনেক এগিয়েছে। বিশ্বায়নের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে কর্মক্ষেত্রে এসেছে ব্যাপক বৈচিত্র্য । আজকের দিনে আমাদের দেশে স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে কী কী ধরনের কাজের সুযোগ আছে, কোন কোন পেশা গ্রহণ করা সম্ভব তা এই পাঠ থেকে আমরা জেনে নেব । পাশাপাশি, আমাদের জন্য ভবিষ্যতে কী ধরনের কাজের সুযোগ তৈরি হতে পারে, সে বিষয়েও জানার চেষ্টা করব । কর্মক্ষেত্র সম্পর্কে গভীরভাবে জানা আমাদের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজন । তবেই আমাদের স্বপ্ন ও আগ্রহের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ পেশা গ্রহণ করতে পারব ।
ব্যবহারিক কাজ :
১। স্বপ্নের পেশা নির্ধারণে সমস্যা চিহ্নিন্ত করণ ও সমাধানের উপায় নির্ধারণ করে ছক তৈরী কর।
২। নিজের জীবনবৃত্তান্ত তৈরী কর ।
অতি সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন :
১। ভোকেশন শব্দটির অর্থ লেখ।
২। বৃত্তি বা পেশা কী?
৩। ক্যারিয়ার গাইডেন্স কী?
৪। ক্যারিয়ার শিক্ষার উপাদান কয়টি?
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন :
৫। স্বপ্নের ক্যারিয়ার মডেল তৈরীর প্রবর্তন কে?
৬। ক্যারিয়ার শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা লেখ।
৭। ক্যারিয়ার শিক্ষাকে কেরিয়ার গঠনের কার্যকর অবলম্বন উক্তিটি ব্যাখ্যা কর।
৮। কর্ম জগতের কোন কোন বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা আবশ্যক ।
রচনামূলক প্রশ্ন :
৯। নিজকে জানা বলতে কী বুঝায় ।
১০। বিকল্প পেশা সম্পর্কে কী বুঝায়?
১১। ক্যারিয়ার শিক্ষার উপাদান সমূহের রেখাচিত্র অংকন কর।
আরও দেখুন...